বড়ভাই নাট্যাংশ ও ওলামা শিশুলীগ

ডক্টর তুহিন মালিক এক. ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার হত্যার নেপথ্যে থাকা কথিত ‘বড়ভাই’ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বত্র। তবে শুধু সিজার একা নন, জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যায়ও নাকি আরেক ‘বড়ভাই’ জড়িত বলে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন। তবে কে এই বড়ভাই, এটা নিয়ে চলছে হরেক রকমের নাটক। একজন আরেকজনকে বড়ভাই বলে ডাকতেও নাকি ভয় পাচ্ছে। আগে কিছু ঘটলে বলা হতো, জঙ্গিরা করেছে। আর এখন বলা হচ্ছে, বড়ভাইরা করেছে। দেশের সব বড়ভাই যখন নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে, ঠিক তখন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বললেন, ‘বড়ভাই আসল নয়, পেছনে রাজনীতিবিদ’। বড়ভাইরা নাকি ইতোমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আবার এই রহস্যের জট খুলে বললেন, বিএনপি নেতা কাইয়ুমই হচ্ছেন এই বড়ভাই। কিন্তু ১২ ঘণ্টার মধ্যেই সুর পাল্টে দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সম্ভবত কূটনৈতিক ও বিদেশী মিশনগুলোতে ‘বড়ভাই নাটক’ গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় তিনি এবার বললেন, বিএনপি নেতা কাইয়ুমের নির্দেশে হত্যা হয়েছে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি নাকি বলেছিলেন ‘হ্যাঁ’। পুনরায় তাকে প্রশ্ন করা হলেও তিনি নাকি ‘হুঁ’ বলেছিলেন। তাই বিদেশী হত্যায় সরকারের সফলতা এখনো শুধুই ‘হ্যাঁ’-‘হুঁ’তেই আটকে রইল।
দুই. অপর দিকে, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ কিন্তু তার ধৈর্যকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি সরাসরিই পশ্চিমা দেশের কর্তাদের উদ্দেশ করে জানিয়ে দিলেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গি খুঁজতে এলে অন্য কাউকে খোঁজার দরকার নাই, বিএনপি-জামায়াতই জঙ্গি’। গত পরশু হানিফ আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে বলে দিলেন, ‘দুই বিদেশী হত্যার নির্দেশ এসেছে লন্ডন থেকে।’ তার এ কথার সাথে সরকারি দলের নেতারা আরেকটু যোগ করে বললেন, ‘আর এই টাকাও এসেছে লন্ডন থেকেই।’ এতেই কাইয়ুম নাটক গুরুত্বহীন হয়ে যায়। লন্ডন নাটকের রোমাঞ্চ শুরু হয়ে যায়। পুলিশের আইজি তখন বলে দিলেন, ‘দুই বিদেশী হত্যা স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্রের অংশ।’ আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো কোনোরকম তদন্ত-বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগেই বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে চূড়ান্ত রায়ই জানিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করলেও শুধু বিএনপির লোকদেরই ধরলেন। নাটক-গল্প যা-ই বানাক, তাদের আসল টার্গেট তো লন্ডনের দিকেই। আর লন্ডন থেকেই যদি টাকা আসে, তবে কিভাবে টাকাটা এসেছে সরকারের তো সবার আগে এটার প্রমাণটা দেয়াই উচিত ছিল। আশ্চর্য, খুন হতে যত সময় লাগে তার চেয়ে কম সময়ের মধ্যেই বিএনপি-জামায়াত কানেকশন তৈরি হয়ে যায়! আর আমাদের গোয়েন্দারাও এত ভালো কাজ করলেন, তাহলে সাগর-রুনির কী হলো? কূটনৈতিক মিশনে অবস্থানরত বিদেশীরাও পড়ে গেছেন এক মহা ফ্যাসাদে। তারা ভাবছে, যে দেশের প্রধান বিরোধী দল আইএস এবং এই সত্যতা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রমাণিত, সে দেশে তারা থাকবেন কী করে?
তিন. এ দিকে বিবিসির সংবাদে প্রকাশ, ইতালীয় নাগরিক হত্যার ঘটনায় মিনহাজুল আবেদীন রাসেলকে আটক করা হয় ১৫ দিন আগেই। তার বাসায় ডিবি পরিদর্শক নাকি তার মোবাইল নম্বরও দিয়ে এসেছিলেন। ১২ অক্টোবর এলাকার রাস্তা থেকে ডিবি পরিচয়ে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। প্রমাণ হিসেবে তার পরিবার নিখোঁজের বিষয়ে ১৬ অক্টোবর বাড্ডা থানার সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দেখায়। পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে হাজির করা আরেক অভিযুক্ত রাসেল চৌধুরীকেও নাকি ১০ অক্টোবর দক্ষিণ বাড্ডার বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে আটক করা হয় বলে প্রথম আলো পত্রিকার বরাতে জানা যায়। আরেক অভিযুক্ত তামজিদ আহমেদ ১২ অক্টোবর নিখোঁজ হলে ডিবি কার্যালয়ে তার সন্ধান না পেয়ে তার পরিবার বাড্ডা থানায় জিডি করে। অথচ এদের আগে গ্রেফতার করে পরে দেখানো হয়েছে কি না, তা জানতে ডিএমপি কমিশনারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, ‘এটা তথ্যনির্ভর নয়’। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে হাজির করা এই চার তরুণ প্রত্যেকেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়ে ‘বড়ভাই’-এর নির্দেশে হত্যার কথা স্বীকার করে এবং বড়ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলে দাবি করলেও, চারজনের একজনও বড়ভাইয়ের নামটা পর্যন্ত মনে করতে পারছে না! এত বড় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও তারা চারজনই নিজ এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল কিভাবে? ঢাকার পুলিশ কমিশনার দাবি করেন, ‘সিসিটিভির ফুটেজ দেখে এই চারজনকে আটক এবং মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করা হয়েছে।’ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সিসিটিভির ক্যামেরায় লাল মোটরসাইকেল থাকলেও, উদ্ধার করা মোটরসাইকেলটি লাল নয়, সাদা ও সিলভার রঙের। এ নিয়ে পুলিশ কমিশনারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত যে আটক মোটরসাইকেলটিই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে, রঙের বিষয়টি নিয়ে ভাবছি না।’ মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশি তদন্তের গ্রহণযোগ্যতার কোনোরকম সদুত্তর দিতে না পেরে উল্টো পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে যারা সহিংসতা চালিয়েছে, তারাই এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আছে।’
চার. জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যার পরপরই বিএনপি নেতা হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের সহোদর রাশেদ-উন-নবী খানকে গ্রেফতার করা হয়। এ মামলার অন্য আসামি হুমায়ুন কবীর নাকি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়ে এই বিএনপি নেতা সোহেলের নাম বলেছেন। অন্য দিকে, পুলিশের খাতায় দীর্ঘ দিন ধরে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ বাড্ডার বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুম নাকি ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার হত্যায় জড়িত। এ যেন একেকটি ডিটেকটিভ কাহিনী, রহস্য-রোমাঞ্চকর শার্লকস হোম আর ফেলুদা অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ! ‘বড়ভাই’ ফ্লপ নাটকের ব্যর্থতার পর জনমনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, বিদেশী হত্যার মতো স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কেও সরকার বরাবরের মতোই রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে কি না? কেননা মহররমের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা হতে পারে বলে সরকারি দলের নেতারা আগেই বলে দিয়েছিলেন মর্মে দৈনিক জনকণ্ঠে আগেই সংবাদ প্রকাশ করে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। তার পরও এই হামলা কেন হয়েছিল? তাতে এটা তো একেবারেই স্পষ্ট যে, এ ক্ষেত্রে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা পুরোপুরি ব্যর্থ। এ ঘটনায় তো সরকারের দায়িত্বশীলদের পদত্যাগ করাই উচিত ছিল। তা ছাড়া দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াই স্বাভাবিক ছিল। অথচ এ ঘটনায়ও সরকার তার মুখচেনা চিরাচরিত সেই তিনটি দুর্বল স্ক্রিপ্টকেই তুলে ধরল। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, বিছিন্ন ঘটনা এবং বিএনপি-জামায়াত কানেকশন। ফলে রেশমা টাইপের পুরনো সেকেলে দুর্বল স্ক্রিপ্ট দিয়ে ‘বড়ভাই’ নাটক তৈরি করাতে শুরুতেই এটা সুপার ফ্লপ হয়ে গেল। অথচ এগুলো করে বড় ধরনের ক্ষতি করা হচ্ছে অপরাধ তদন্ত ও প্রকৃত দোষীদের বিচারে সম্মুখীন করার আইনি প্রক্রিয়ার। অপরাধের রাজনৈতিক লেবেলের কারণে অপরাধীরা নিষ্কৃতি পেয়ে যাচ্ছে। প্রতিপক্ষকে দোষারোপ, অপরাধকে রাজনৈতিক দমননীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, বহির্বিশ্বে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে জঙ্গি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা, অপরাধের তদন্ত না করেই ফলাফল ঘোষণা, চরম বিচারহীনতা ও নৈরাজ্য, ডিনায়াল সিনড্রোম এবং নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করার এই অপসংস্কৃতির কারণেই প্রকৃত অপরাধীরা এভাবে রয়ে যাচ্ছে বরাবরের মতো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
পাঁচ. ক’দিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের রাস্তায় ওলামা লীগের দুই গ্রুপের মারামারি-চুলাচুলির পর ওলামা লীগ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, এত দিন ধরে আনসারুল্লাহর নামে পাঠানো সবগুলো ই-মেইল আসলে ওলামা লীগের একাংশের নেতারাই পাঠিয়েছে। ব্যাস, কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের কথার প্রমাণও পাওয়া গেল। পুরান ঢাকার হোসনি দালানে মহররমের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার ঘটনায় প্রথমবারের মতো দেশবাসী আনসারুল্লাহর নামে কোনো ই-মেইল পায়নি। যদিও সিরিয়ায় যুদ্ধরত আইএস বাহিনী এই বোমা হামলার দায় স্বীকার করে নাকি ই-মেইল পাঠিয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। তবে বাংলাদেশে ‘আনসারুল্লাহ ই-মেইলে’র পতনের পর, এবার ‘আইএস ই-মেইল’ মঞ্চস্থ হওয়ায় এটাও আবার ওলামা লীগের আরেক অংশের কি না, তা জানতে ওলামা লীগের দুই গ্র“পের আরেকবার চুলাচুলি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যেই ওলামা লীগের এক গ্র“প আরেক গ্র“পকে যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার ও জঙ্গি বলেও দাবি করেছে। তার মানে কাছে থাকলে সঙ্গী, বিরোধ হলেই জঙ্গি! আসলে এ দেশের আলেম ওলামাদের পবিত্র নামকে ব্যবহার করে ওলামা লীগের দুই গ্র“পের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আর প্রকাশ্য রাজপথে মারামারি করিয়ে কাদের বহির্বিশ্বে জঙ্গি প্রমাণের চেষ্টা করানো হচ্ছে? ছাত্রলীগের মুখে দাড়ি গজালেই আলেম হওয়া যায় না। প্রকৃত আলেমরা কখনো ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগাভাগির জন্য কারো দালালি করতে পারে না। অথচ ওলামা লীগের মারামারির অনুষ্ঠানস্থলেই সেদিন নাকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ‘শহীদ’ এবং নামের পরে ‘রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’ শব্দ দুটি সংযুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। আরো বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, ওলামা লীগের মারামারির সময় টুপি পরা শিশুদের লোহার রড হাতে নিয়ে নিজেদের বয়স্ক নেতাদের পেটানোর ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে জনগণের মনে প্রশ্ন জাগে, দেশে আবার ‘ওলামা শিশুলীগ’ কবে জন্ম নিলো?
ছয়, বিগত কয়েক বছর ধরে পত্রিকার পাতা উল্টালেই জঙ্গি সন্দেহে জিহাদি বই ও লিফলেটসহ গ্রেফতারের খবর পাওয়া গেছে নিত্যদিন। জঙ্গি সংগঠনকে অর্থায়নের অভিযোগ, এমনকি ‘মৌলবাদী অর্থনীতির’ তত্ত্ব পর্যন্ত আওড়াতে দেখা গেছে। জঙ্গি সংগঠনের সেকেন্ড ইন কমান্ড বোধ হয় গোটা কয়েক ডজনকে ধরা হয়ে গেছে। রাজপথ, টিভি এবং সংসদে প্রতিনিয়ত মন্ত্রী-এমপিরা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে জঙ্গি বলে সম্বোধন করেন। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতকে জঙ্গি বলেই ডাকেন। আওয়ামী লীগের নেতা হাছান মাহমুদ তো সরাসরি বলেই দিলেন, ‘মিসর, তিউনিসিয়া ও সিরিয়ায় জঙ্গি হামলার জন্য বেগম খালেদা জিয়াই দায়ী।’ দেশে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে যে, গণতন্ত্র ও নির্বাচনের প্রশ্ন আসামাত্রই ধারাবাহিকভাবে ইসলামি বইকে ‘জেহাদি বই’ বা ‘জঙ্গি বই’ আখ্যা দিয়ে জঙ্গি ধরা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে চললে তো মুসলমানদের ঘরে ক’দিন পরে আর কুরআন হাদিসের কোনো বই রাখাই যাবে না।
সাত. আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের বড় তত্ত্ব ছিল ‘জঙ্গি কার্ড’। জর্জ বুশ গোটা বিশ্বে চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামের জঙ্গি কার্ড খেলে প্রতিপক্ষকে নিধন করেছেন। আমরাও বুশের মতো জঙ্গি কার্ড খেলে ভিন্নমতাবলম্বীদের গায়ে জঙ্গি তকমা লাগিয়ে ভোটাভুটি ছাড়াই অনায়াসে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রেখেছি। অন্য দিকে দেশে যে অপরাধই ঘটুক না কেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কষ্ট সহ্য করে সেগুলোর আর তদন্ত করার প্রয়োজন হয় না। কোনো না কোনো ইসলামি নামের জঙ্গি গোষ্ঠীর নাম দিয়ে সাথে সাথে ইন্টারনেট, ফেসবুক বা ই-মেইলে সব অপরাধের দায় স্বীকার করে নেয়। কখনো এরা হয় আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী কখনো বা আবার আলকায়েদার ভারতীয় শাখা। ঘরে বসে সাত-আটজন মিলে কথা বললেও পরদিন পত্রিকায় খবর আসে যে, গোপন বৈঠক কালে জঙ্গি গ্রেফতার। আর আমাদের তথ্যমন্ত্রী তো প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে জঙ্গিদের শেকড় উপড়ে ফেলার কথা বলে আসছেন। এভাবে জঙ্গি খেলা খেলতে খেলতে এবার যখন আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া চলে এলো, তখন সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন দেশে জঙ্গির অস্তিত্ব নেই। তা হলে যাদের এত দিন ধরে ধরা হলো তারা কারা? মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো, তা হলে এত দিন জঙ্গি দমনের নামে কাদেরকে দমন করা হয়েছে?
আট. বাস্তবতা হলো, যারা প্রতিনিয়ত জঙ্গি জঙ্গি বলে চিৎকার করে তারাই আসলে বড় উগ্রপন্থী। যদি প্রশ্ন করা হয়, ৫৭টি মুসলিম দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোনো দেশে ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করা হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের নামই সবার আগে স্থান পাবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একবার কয়েক ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশ সফরে এলে বাংলাদেশের জঙ্গিদের নিয়ে ভয়াবহ বই ছাপিয়ে তা ক্লিনটনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। শঙ্কিত ক্লিনটন সাভার স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন বাতিল করে দ্রুত এয়ারপোর্ট ত্যাগ করেন। আসলে যেসব পরগাছা রাজনীতিবিদ সারা জীবনেও পাঁচ শ’ ভোটের বেশি পাননি, সেই ট্যাংক-ড্যান্সার পদবিলোভীরাই আজ দেশে জঙ্গিতত্ত্ব¡ উদ্ভাবন করে দেশের বারোটা বাজাতে চলেছে। ক্ষমতার মোহে নিজেদের বাদে বাকি সবাইকে জঙ্গি বলে সম্বোধন করাটা একটা দেশের তথ্য মন্ত্রণালয়ের একমাত্র কাজ হতে পারে না কখনো। অথচ সরকার এসব ঘটনাকে যতই রাজনৈতিক রঙ মাখিয়ে ‘জঙ্গি’ আর ‘বড়ভাই’ তত্ত্ব আবিষ্কার করুক না কেন, বিদেশীরা কিন্তু নিজেদের নাগরিকের হত্যাকারী কে হতে পারে তা ঠিকই বুঝতে পারে। এ কারণেই মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যাটফোর তাদের মূল্যায়নে বলেছে, ‘বাংলাদেশের বিরোধী দল দমনে সন্ত্রাসী ঝুঁকিকে ব্যবহার করতে চাইছে ক্ষমতাসীনেরা।’
নয়. দুই বিদেশী হত্যায় ‘বড়ভাই’ নাট্যাংশের প্রথম পর্ব এখন চলছে। যদি এই নাটক দর্শকেরা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে, তবে পরবর্তী পর্বগুলো হবে বেশ রোমাঞ্চকর। শ্বাসরুদ্ধকর পরবর্তী পর্বগুলো এগিয়ে যাবে কঠিন থেকে কঠিনতম ক্লাইমেক্সের দিকে। ইতোমধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় দেয়া বক্তব্যে ব্রিটেনে অবস্থানরত বাংলাদেশের জঙ্গির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে ঠিকই অনুরোধ করে রেখেছেন। তার পরপরই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে আমেরিকার সাহায্য চেয়ে তেলাপোকার গায়ে কালেমার বাণী অঙ্কন করে ওয়াশিংটন টাইমসে একটি নিবন্ধও লিখে রেখেছেন। তাই নিকট ভবিষ্যতে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের ‘ইরাক যুদ্ধের পরিণামেই জঙ্গির উত্থান ঘটেছে’- এ কথার মতো আমাদেরও না আবার বলতে হয়, ‘৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের পরিণামেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জঙ্গিতে পরিণত হয়েছে।’
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর